১।
কুখুঁড় মেয়েটা খুব দুষ্টু। মা বাবা কারোর কথা শোনা ওর ধাতে নেই। যখন সবাই বলে ডানে চলতে ও চলবে বাঁয়ে। মা বলে, জন্ম থেকে জ্বালাচ্ছে।যেন হয়েইছে সবাইকে দুশ্চিন্তায় রাখার মহান দ্বায়িত্ব মাথায় নিয়ে। ওকে বলা হল প্রতিদিন নেয়ে আসবে, গায়ে ময়লা খড়ি ধুলাবালি মাখিয়ে নিয়ে সারাদিন টইটই করে সে কোথা থেকে ঠিক খাবার সময় উদয় হবে। তা বলে কি খাওয়ায় ওর বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে? নাহ, সে আধেক খায়, আধেক ফেলাছড়া করে। কত কষ্টের খাবার কত ঝুঁকি নিয়ে জোগাড় করতে হয়। এভাবে নষ্ট হলে কেমন লাগে?কিন্তু ঐ যে সে কুখুঁড়, সে তার ছোট্ট মাথাটা হেলে এমনভাবে তাকাবে যে বকুনি ভুলে গিয়ে সবার হাসি পায়। আর সব রাগ ধুয়ে জল হয়ে যায়।সারাদিন খেলা খেলা করে কাটানো চলে না, কাজও তো শিখতে হয়। এখন না হয় ছোট , তবু ওদের সমাজে বেশীদিন বসে খাবার নিয়ম নেই। নারী পুরুষ কারোরই। মেয়ের বুঝি সেদিকে মন আছে? গায়ে হাওয়া লাগিয়ে দিন কাটায়।
হিম হিম হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এবার ওরা সবাই মিলে দূরে যাবে। কুখঁড় জানে শুধু সেটাই । কোথায় কেমন হবে অ-ই নাদেখা স্থান সে পরিচয় তার নেই। যতই নির্বিকার ভাব সে দেখাক উপরে উপরে এটাই তার জীবনে প্রথম বেড়াতে যাওয়া।বার্ষিক এই ভ্রমণের কথা শুধু সে গল্পে শুনেছে , আজ পর্যন্ত কখনো যায়নি। ভিতরে ভিতরে সে উত্তেজনায় তাই টগবগ করে ফুটছে।কবে আসবে সেই দিন?মনে মনে হিসাব করতে থাকে সে। দশ পনেরো দিন বাকি থাকতে , কাঠি গুনে খুঁজে খুঁজে সাজায়। একটা একটা দিন পার হয় আর একটা করে কাঠি ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এই প্রতীক্ষারও রোমাঞ্চকর মজা আছে। মায়ের বাবার বড় ভাই বোনের উপদেশ বাণীগুলো , কিভাবে সাবধানে থাকতে হবে, কি কিভাবে কিসের ব্যবস্থা করে নিতে হবে, জোগাড়যন্ত্র তার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়।
২।
সময়ের গাড়িতে যথাসময়ে গড়িয়ে গড়িয়ে শীতবুড়ি এসে পড়ে। ওরা সবাই রওনা দেয়। যেতে হবে অনেক অনেক দূর, এখন কুখুঁড়ের দূরন্তপনাও অনেকটা ঝরে গেছে। শুরুতে উত্তুঙ্গ হাওয়ার বেগে সে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল, চলে গিয়েছিল অনেকটা পথ সবার চেয়ে আগে যাবার নেশায়। তাইতে দাদুর ধমক খায় , এখন এত জোরে ছুটলে হবে? যেতে হবে আরো অনেক হাজার মাইল। শক্তি জমা করে রাখতে হবে তার জন্য।বকুনি খেয়ে কুখুঁড় পিছিয়ে আসে, ফের দলের সাথে মিশে যায় ।এখন দূর থেকে দেখলে ওকে আর ঝাঁকের মধ্যে আলাদা ভাবে চেনা যাবে না , তবু অন্যদের চেয়ে একটু ছোট যারা তাদের দলে মধ্যে একটু বেশী ছটফটে মেয়েটাই কুখুঁড়।
নতুন জায়গায় এসে ওদের সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অনেক ধকল গিয়েছে রাস্তায়। ওদের দেশে এতদিনে কনকনে শীতল প্রবাহ বইছে ।কুখুঁড় শুনেছে ওখানে এখন আকাশ উদোম করে বরফের ফুল ভরা টুকরীটা উল্টো হয়ে পড়ে, কেবলই ঝরছে আর ঝরছে। সে ভাবে প্রতিবারই বছরের এই সময়টায় এখানে চলে এলে সে এই জিনিস কখনো জীবনে দেখবে না।একটু মন খারাপ হয়, তবু এই ভাবটা সে মুছে ফেলে । অল্পবয়সে অনুভূতির গভীরতাও অল্প সময় থাকে।আর এই যে এখানে সে এসেছে, দিগন্তরেখা পাড়ি দিয়ে এটাও তো বেশ একটা নতুন রকম অভিজ্ঞতা। সব কিছু বদলে যাওয়া। শুষ্ক রাস্তাঘাট, আকাশ পানে সবকটা সরু লম্বা মোটা খাট হাত বাড়িয়ে আছে বৃক্ষসারি । উদাত্ত হয়ে নগ্ন এই যে শীতের কামড় সয়ে যাচ্ছে এ থেকে বাঁচার প্রার্থনা করছে বুঝি ওরা।সূর্যটা টিমটিমে লাল কুসুমের মত। সেইরকম -যখন অকালে বুঁইড় খালার ডিম ভেঙে গেলে ভিতরটায় সে দেখতে পেয়েছিল। তবে এখানে খাবার দাবারের অভাব তেমন নেই। আর এই শীতে পথের নেড়ী কুকুরটা পর্যন্ত কুঁকড়ে আছে মনে হলেও কুখুঁড়ের মসৃণ উপযুক্ত ডানার পালক ওর জন্মগত ওমে ওকে আরাম দেয়। চারপাশের সবাইকে বিশেষ করে দুপেয়ে জীবগুলোকে দেখে ওর খুব মজা লাগে, ভারী তো শীত , এতেই সবাই এত কাবু, সোয়েটার মোজায় ফুলবাবু!
যদিও নদী গুলো চিকন চিকন ফিতার ফালির আকার নিয়েছে তবুও এই মরা মৃদু আলোয় ওরা জলা খুঁজে খুঁজে আস্তানা নেয়। বেশ কাটছে এই দিনগুলি।
৩।
এখানে এসেও কুখুঁড় প্রথম কিছু দিন চুপচাপ ছিলো বলে বড়রা সবাই বেশ নিশ্চিন্ত ছিলো । নতুন জায়গা- কি বিড়ম্বনায় পড়তে হয় ভেবে তখন কারো কথার বাইরে সে কথা বলেনি, চলেনি। তবে এখন ওর একটু সাহস বেড়েছে, একটু বেপরোয়া হয়েছে। একদিন ঘাপটি মেরে ঝোপের তলায় লুকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ , মতলব- কেমন করে ঘাবড়ে দেবে সবাইকে। কুখুঁড় কই ....???? কুখুঁড় নেই...!!!!!
একটা সময় যেতে সবাই খুব খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলো । সবাই কাঁদছে। এমন সময় অনুতপ্ত কুখুঁড় বের হয়ে এলো। ওরা সবাই এত ভয় পেয়েছে কেন? এত ভাবনার কি আছে?পরে মা তাকে খুব করে কসম কাটিয়ে নিলো, আর কখনো এভাবে সে দলছুট হবেনা, ওদের অবাধ্যতা করবেনা।
কুখুঁড় আজ দলাপালানো হয়নি, শুধু আনমনা হয়ে চলে এসেছিল একটু বাইরের দিকে।বেখেয়ালে, ইচ্ছাকৃত না। ডানায় তীব্র একটা ব্যাথার মোচড়ে ওর ধ্যান ভাঙে। কি হয়েছে? কুখু্ঁড় সভয়ে দেখে কেমন টকটকে হয়ে উঠলো দেখতে দেখতে ওর জখমি জায়গাটা। আহত সে উড়ে যেতে চেষ্টা করলেো কিছু দুপেয়ে মানুষের শব্দ সে শুনতে পেয়েছে। হ্যাঁ ওদের থেকে যথাসাধ্য দূরে নজরের বাইরে থাকতে ওকে সবাই পইপই করে বুঝিয়েছিল। না হলে কি হবে? খব বিপদ হবে। ছোট বলে ওদের নৃশংসতাটা ওকে অত ভেঙে কেউ বলেনি, বলতে পারেনি।মানুষ বড় খারাপ , নিষ্ঠুর। বাচ্চা মেয়ে ভয় পাবে। ধরতে পারলে মেরে কেটে খেয়ে ফেলবে একথা কেমন করে বলা যায় ওকে? কুখুঁড় ছোটে , ছটফটিয়ে ওঠে। ওর পাখা ক্রমশই দূর্বল হয়ে উঠছে , কিন্তু মনে আতঙ্ক তাড়া করছে- শুধু তারই জোরে সে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এভাবে এই গতিতে চললে ধরা পড়ে যাবে। ঝোপঝাড় মাড়িয়ে এগিয়ে আসছে শিকারীর দল , প্রাণপণ বলে সে লাফায় , ওড়ে , আর্তনাদ আর রক্ত ঝরে ঝরে বাতাসে মিশে নিশান রেখে যায় ওর পথের।
৪।
ধরা পড়লে কি হতো ভাগ্যক্রমে কুখুঁড় তা জানতে পারেনি। একসময় অবসন্ন মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে ছিল পথের মাঝে। এতদিন সবল শরীরে ওর তেমন শীত করেনি এখন এই দেশের সামান্য ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগছে।কাঁপছে থির থির। চোখ বুজে বুজে আসছে, আর বেশীক্ষণ সে খোলা রাখতে পারবে না, একসময় চিরদিনের জন্য ঘুম পাড়বে সে। মা, বাবা, ভাইবোনগুলো, প্রতিবেশী চেনাজানা সবার কথা কুখুঁড়ের মনে পড়ছে। ওর এই দশা জানতে পারলে সবাই খুব কাঁদবে। তবে হয়ত জানবে না। তবু অনুমান তো করতে পারবে। এখনো ঘ্রাণ- আপন- না- হয়ে ওঠা এই ভিনদেশী মাটিতে সে শুয়ে থাকবে সবার অজান্তে।
শিউলি একা একা ব্যাগ নিয়ে চলছিল পথে। আজ ওর সখী রমিলা আসে নি । জ্বর হয়েছে ওর।দাঁত খুঁটতে খুঁটতে নিচের দিকে তাকিয়ে মনমরা হয়ে পথ চলছিল সে।মাঝে ওটা কি পড়ে আছে? এমা, একটা পাখি! না পাখির ছানা- আহা! ডানাটা কেমন দুমড়ে গেছে গো। কিভাবে এমন হলো? বুঝেছি মোড়লপো'র দলবলের কাজ এ। শিউলি সযত্নে আলগোছে পাখিটা তুলে নেয়। আজ আর ওর গন্তব্যে যাওয়া হবে না। ফেরত পথ ধরে সে। বাসায় ফিরে সাততাড়াতাড়ি পানি দিয়ে ধোঁয় ক্ষতস্থান। ঔষুধের বাক্স ঘেঁটে বের করে ব্যান্ডেজ, মলম। মানুষেরটা কি পাখির বেলায় খাটে? ভাবার সময় নেই । বেশ করে ঘষে ঘষে লাগায় সে। পাখির এত ছোট বাচ্চাটাকে কিভাবে কেউ খাবার জন্য মারতে পারে? অদৃশ্য শিকারীর লোলুপ জিহবাকে সে গাল দেয়।সব পরিচর্যা শেষে লুকিয়ে রাখে নিরাপদ বদ্ধ জায়গায় । কেউ দেখতে পেলে কিংবা কুকুর বিড়াল শেয়ালে খেয়ে ফেললে? সর্বনাশ!
সেদিন কামাই দেবার জন্য যথোপযুক্ত অজুহাত না থাকায় বেশ বকুনি জুটেছিল শিউলীর কপালে। সব কথা সে ভুলে যায় যখন পাখির ছানার কাছে আসে। আস্তে আস্তে কেমন সবল হয়ে উঠছে বাচ্চাটা। বড় মায়া লাগে। রান্নাঘর থেকে নিজের খাবারের একাংশ পিষে পিষে সে খাওয়ায় পাখিকে।ও একটা নামও দিয়েছে পাখির । মিষ্টি মায়ামায়া চেহারার পাখির নাম- মিঠাই। ঐ নামে সে ডাকে। পাখিটা বেশ সাড়া দেয় ,শিখে ফেলেছে নিজের নাম। শিউলি ভাবে ওর কতদিনের শখ ছিল নিজের করে একটা পাখি পাওয়া, এত দিনে সেই ইচ্ছাপূরণ হয়েছে। পাখিটা ছোট বলেই খুব তাড়াতাড়ি ওকে চিনে ফেলেছে।বড় হলে এত সহজে কাছে আসতো না। এখন হাতে নির্ভয়ে বসে বসে দানাপানি খায়। ঘরে ঢুকলে এগিয়ে আসে। ডানা এত দিনে একটু একটু শক্ত পোক্ত হয়েছে সেটা নেড়ে ঝাপটা মেরে ওর ঘাড়ে মাথায় উঠে বসতে চায় ।
৫।
ছোট কুখুঁড় ভাবে, সে শুনেছে মানুষ খুব খারাপ । কিন্তু সবাই না। এই যেমন এই মেয়েটি।কি যত্নআত্তি করে রেখেছে ওকে। এত ভালো ভালো খাবারের নিশ্চিন্ত জোগাড় ওদের নিজেদের ঘরে কখনো ছিল না। এক বেলা খেলে পরের বেলা কি জুটবে জানা নেই । মেয়েটা ওর আজব একটা নাম দিয়েছে, সেই নামেই সে তাকে ডাকে? মিঠাই -এ আবার কেমন নাম? মেয়েটা কি জানেনা, ওর নিজের একটা খুব সুন্দর নাম আছে, কু-খুঁ-ড়? অবশ্য ঐ অদ্ভূত নামটা ছাড়া মেয়েটার আর সবই ভালো। কেমন দয়ামায়া ভরা মিষ্টি স্বভাব। এখন ও একটু বড় সড় হয়ে উঠেছে। ডানার দাগ পর্যন্ত হারিয়ে গেছে। অবস্থার উন্নতি দেখে শিউলি ওকে বার কয়েক বাইরে নিয়ে গেছে। তবে তখন ডানা নাড়াচাড়ার বেশি কিছু সে করতে পারে নি। ভয় লাগে , যথেষ্ট জোর কি হয়েছে ওতে ।আগের মত উড়তে কুখুঁড়ের বড় ইচ্ছা করে। বাতাসে নিঃশব্দ শীষ কেটে কেটে চলার জন্য ওর ডানার প্রান্তগুলো আকাঙ্খায় আন্দোলিত হয়। ঠিক তখনি শিউলি ওকে কব্জা করে তার কঞ্চি দিয়ে বানানো নতুন খাঁচাটায় পুরে দেয়।
সেদিন কুখুঁড় বেশ লাফ ঝাপ করছিল। আর এখন ওকে নিয়ে বেশি ভয়ও নেই ভেবে শিউলি আবার ওকে বের করে আনে। বশ মেনেছে বোধ হয় । আশে পাশে ঘুরঘুর করে , হয়ত পালিয়ে যাবে না। আর এখন ওকে কেউ মেরে ধরে নিতেও পারবে না। সম্পূর্ণ সুস্থ সতেজ সে।
কুখুঁড় ডানা ঝাপটায়। বেশ চমৎকার কাজ করবার মতো হয়েছে ওদুটো ।আহত হবার আগের সাবলীলতা ফিরে এসেছে পুরোপুরি। কতদিন পার হয়েছে ওর এখানে? এখনও কি জলার ধারের ঝাড়ের প্রান্তরে ওর পরিজন সাথীরা আছে? ওর পথ চেয়ে? ওদের যেন সে স্পষ্ট দেখতে পায় । অজানা মৌগন্ধ উঠানের কোন থেকে ভেসে আসে। দূরে কোথাও একটা পাখির কর্কশ ডাক, ওর স্বজাতি না। ঘাসফড়িঙের পাখার সড় সড় শব্দ , পিপীলিকার সারির নীরব সচল সরলরেখা। ওর মনের ভিতরে কিছু নড়ে চড়ে যায়। শিউলির কাছ থেকে এক পা এক পা করে সরে। শিউলি ওকে অন্তরে টানে আবার কানে সুর বাজায় আরো গহন আহবান। দোটানায় কুখুঁড় ভয় পায় , নাড়া খায়, পায়ে পায়ে আবার ফিরে যায় শিউলির কাছে।সে ওকে তুলে নিয়ে ওর মাথার পালক এলোমেলো করে একটু আদর করে দেয়।মেয়েটার হাতের উষ্ণতায় নিজেকে নিরাপদ লাগে কুখুঁড়ের । কোল থেকে নামিয়ে আবার ছেড়ে দেয় নির্ভীক বিশ্বাসপ্রবণ শিউলি । কুখুঁড় আবার দূরে সরে যায়, শিউলিকে ঘিরে ওর বৃত্ত বড় ,আরও বড় হয় ক্রমশ। বনের পথের দূরের ডাক আরও প্রবল হয় । প্রবল থেকে প্রবলতর। অন্তঃস্থ আকর্ষণে ছিটকে পরে কুখুঁড় ওর ভারসাম্য ভরকেন্দ্র থেকে। ডানা মেলে দুপাশে ছড়িয়ে দেয় । বন্ধ করে। আবার ছড়ায়। তারপরে জোরসে ঘনঘন ঝাপটাতে শুরু করে। ছোট একটু ঝটকা তুলে অনেকখানি উপরে ওঠে। আরও আরও উপরে উঠে যায়। ওর আরোগ্য মেলা ডানায় দূর্নিবার তেজ এখন , নির্বিকার একবারও পিছন না ফিরে আত্নবিশ্বাসী উড়ে চলে, সে জানে তাকে কোথায় যেতে হবে।